কেন আমি বাংলায় ব্যাখ্যা লিখছি
It’s not a bug, it’s a feature!
আমি যখন স্নাতক শুরু করি, তখন একটা ধাক্কা খাই। প্রমিত বাংলা ভাষার ধাক্কা। আমি চট্টগ্রামের ছেলে - আমার কথায় যে একটা আঞ্চলিক টান আছে এই বিষয়ে আমি খুবই অজ্ঞাত ছিলাম। আমি যখন প্রথম ঢাকায় এসে প্রমিত বাংলায় কথা বলার চল শুরু করি, অনেকেই হেসেছিল প্রথম প্রথম, দেখিয়েও দিয়েছিলো অনেকেই।
খুব খারাপ লেগেছিলো তখন। মোবাইলে রেকর্ড করে শুনতাম আর সংশোধন করতাম। এখন হাসি পায়। আমি আমার আঞ্চলিক টান নিয়েই খুশি।
It’s not a bug, it’s a feature! মাইল্লেফিরে !
Breath in English
কলেজ পর্যন্ত সারাজীবন বাংলাতে সব পড়েছি (ব্যতিক্রম - ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র)। কথা বলতাম বাংলায়, মাইরও খেতাম বাংলায়। খাটি বাংলায়। শুধু ক্লাশে উপস্থিতি দিতাম ইংরেজিতে। Present Sir/Madam!
কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠার পর আরেক ধাক্কা খাই। ইংরেজির ধাক্কা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ইংরেজির রাজত্ব। আমাদের পড়ার বইগুলো ইংরেজিতে, ক্লাশের স্লাইডগুলো ইংরেজিতে, পরিক্ষার ভাষা ইংরেজিতে - সব ইংরেজিতে। মহা মুসিবত। এত ইংরেজ কিভাবে হব? আমার দক্ষতা শুধু পড়া আর লিখা পর্যন্ত। বলতে গেলেই গলা শুকিয়ে কাঠ।
ওইদিকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের টার্গেট - প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বানাতে হবে গ্লোবাল সিটিজেন। আমাদের এক স্যার একদিন বললেন, You have to breath in English। আমার তো দম বন্ধ হবার যোগাড়। আস্তে আস্তে ইংরেজিতে দম নেয়া শিখতে হল।
ভাষার ম্যাজিক
আমি রিসার্চ শুরু করি ২০১৫ সালের শেষের দিকে, আন্ডারগ্র্যাডে থাকার সময়। তখন আমার ইংরেজির দক্ষতা (অন্তত পড়ে সারমর্ম বোঝার মত) মোটামুটি ভালো থাকার পরও খুব কষ্ট হত ইংরেজিতে লিখা রিসার্চ পেপারগুলো বুঝতে। যেহেতু ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা, সেহেতু ইংরেজিতে রিসার্চ পেপার লিখা হবে - এটা যুক্তিসংগত। কিন্তু ইংরেজিতেই বুঝতে হবে, এই ধারণা পাল্টেছে কোরিয়াতে আসার পর।
কোরিয়াতে এক আজব অবস্থা। এদের ইংরেজি আমাদের থেকেও খারাপ। যেকোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে এদের ইংরেজিতে ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করলে ইংরেজির ক্ষুদ্রান্ত্র বের করে ফেলবে। কিন্তু একই বিষয় যদি ওদের নিজেদের ভাষায় বলতে বলেন, তারা এতো সুন্দর করে ব্যাখ্যা দিবে যে আপনার নিজের অর্জিত জ্ঞানের উপর ভরসা উঠে যাবে। একটাই প্রশ্ন আসবে - কি করলাম জীবনে?
আমার খুব ভালো লেগেছে এই বিষয়টা। তারা ঠিকই ইংরেজি রিসার্চ পেপার পড়ছে - কিন্তু বিভিন্ন ব্লগে ব্যাখ্যাগুলো লিখছে কোরিয়ানে। যারা পড়ছে তারা সব কন্সেপ্ট বুঝতে পারছে - কারণ একটাই - মাতৃভাষা । একই অবস্থা চীন আর জাপানে। তারা নিজের ভাষায় সব করছে।
বড় বড় পাবলিশাররা তাদের সব ইংরজি বই কোরিয়ানে ট্রান্সলেট করে বিক্রি করে। তারা ভালো করে জানে, অন্য ভাষায় বই বের করলে কোরিয়ানরা পড়বে না।
They are not breathing in English. They are probably dead.
কেন আমি বাংলায় ব্যাখ্যা লিখছি
কারণ আমি চাই আমাদের যারা নতুন গবেষক হতে চায়, তারা যেন কন্সেপ্টগুলো নিজেদের ভাষায় বুঝতে পারে। রিসার্চ পেপার ইংরেজিতে হোক, আপত্তি নেই। ইংরেজিতেই বুঝতে হবে - এতে আপত্তি আছে।
কারণ ‘If you don’t come home early, it will be a problem for you’ থেকে “বাসায় দেরি করে আসলে আজ তোর একদিন কি আমার একদিন” বোঝা সহজ।
বাংলায় হোক গবেষণা
প্রথমত, বাংলায় ডিপ লার্নিং নিয়ে অনেকেই ধারাবাহিকভাবে টিউটোরিয়াল বা বই লিখেছেন। সবগুলো টিউটোরিয়াল বা বই খুব গুছানো এবং চমৎকার। তবে, অধিকাংশ টিউটোরিয়াল বা বইয়ে শুরুতে থিউরির কিছু আইডিয়া দিয়ে সরাসরি কোডিং বা মডেলের দিকে চলে যাওয়ার প্রবনতা দেখেছি। আমি আমার লেখাগুলোতে তা এডিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। উদ্দেশ্য খুব সাধারণ - যেনো যে কেউ (কিছু ম্যাথের বেসিকসহ) ডিপ লার্নিং নিয়ে কাজ শুরু করার একটা ভালো বেসিক আর স্ট্রং স্টার্টিং পয়েন্ট পায়।
দ্বিতীয়ত, এই লেখাগুলো আমার নিজের রিভিশন হিসেবেই নিবেন। আমি চেষ্টা করব যেনো সহজতর ভাষায় লেখা যায়। যদি কোনো লেখা পড়ে মনে হয় যে খুব কঠিন হয়ে গেছে, তার মানে - হয়তো এর থেকে সহজ ভাবে লিখা সম্ভব না অথবা আমি নিজে বিষয়টা খুব গভীরভাবে বুঝি নাই বলে সহজভাবে বুঝাতে পারি নাই। দুইক্ষেত্রেই ক্ষমাপ্রার্থী।
তৃতীয়ত, আমি নিজের গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। যখনই সময় পাব, তখনই লেখার চেষ্টা করব। যদি কোন কারণে লেখায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিদিন বিরতি পড়ে, তাহলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। অজুহাত হিসেবে নিজের গবেষণাকে টানা ছাড়া উপায় নেই। যদি আমার লেখায় কোন ভুল বা অসংলগ্ন ব্যাখ্যা অথবা সময়োত্তীর্ণ তথ্য পান, দয়া করে জানাবেন। আমি সংশোধন করে নিব।
এই লেখাগুলো শিক্ষামূলক কাজে সবার জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত।
বাংলায় জ্ঞানচর্চা শুরু হোক।
সৈয়দ নাদিম